নিষ্কৃতি
-রোমুলো গ্যালোগোজ
অনুবাদে- বর্ণালী জানা সেন
ঐ দূরে যে পাহাড়টা খাড়া উঠে গেছে তার পাশেই গভীর অতলান্ত খাদ। অসংখ্য বুনোলতা পাহাড়টাকে সাপের মতো পেঁচিয়ে রয়েছে। খাদের ঠিক গা-ঘেঁসে কাঁটা গাছের ঝোপ। পাহাড়ের ঠিক গায়েই সেই বাড়িটা। বাড়ি বলা ভুল…ভাঙাচোরা একটা কামরা। সে ঘরের চিমনি দিয়ে বহুকাল কোনও ধোঁয়া ওঠেনি। ঘরের ঠিক দোরগোড়ায় উদাস মুখে বসে আছে চিররুগ্ন ছেলেটা। মানুষ তো নয় যেন একটা কংকাল…কুচ্ছিত…কদাকার। ঝাঁটার কাঠির মতো চেহারায় বিশাল একটা মাথা। মাথায় কয়েকগুছি চুলও নোংরা…জট পাকানো। কতকাল যে তেল, সাবান, চিরুনি পড়ে না! পেটটা ফুলে ঢোল। হাড্ডিসার দুটো পায়ে যত রাজ্যের খোসপাঁচড়া। হাঁটু আর পায়ের দুটো পাতায় জল জমেছে। মুখের চামড়া রুক্ষ খসখসে। হাড়ের ওপর শুধু চামড়ার একটা পরত। মুলোর মতো দাঁতগুলো মুখের বাইরেই বেরিয়ে থাকে সারাক্ষণ। কোটরে ঢোকা চোখদুটো অস্বাভাবিক হলুদ। ঐ চোখ দিয়েই সে যেন কিছু বলতে চায়। ঐ ঘোলাটে চোখের ভাষায় তীব্র এক যন্ত্রণা…মুখে যা প্রকাশ করা যায় না।
সারাদিন পাথরের মতো দরজায় সামনে সে বসে থাকে। আর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দূরের সবুজ পাহাড়গুলোর দিকে। যেদিকেই চোখ যায় শুধু পাহাড় আর খাদ। সাগরের ঢেউয়ের মতো ঐ ঢেউ খেলানো পাহাড়্গুলোও সব নীল দিগন্ত রেখায় গিয়ে মিশে গেছে। ছেলেটার মনে উথাল-পাথাল। কেন যে তার মনে এত বিষ! সামনে যা পায় তার ওপরই বিষ উগরে দিতে চায়। এই সৃষ্টিশুদ্ধকে সে ভেঙে তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করে। দিন রাত রাগে সেগুমরে গুমরে মরে । মাঝে মাঝে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। কিন্তু গলার কাছে কী যেন একটা দলা পাকিয়ে আসে। এই মরা চোখে জলও আসে না! রাগলে সে আর মানুষ থাকেনা। সহস্র দানবের শক্তি যেন ভর করে তার শরীরে। দাঁতে দাঁতকপাটি লেগে যায়। হাতের সামনে যা পায় ছিঁড়ে খুঁড়ে একসা করে মনে একটু শান্ত পায়। প্রচন্ড ঝড়ের পর প্রকৃতি যেমন শান্ত হয়ে যায় তেমনই প্রলয়ংকর তাণ্ডব চালিয়ে সেও আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়ে। একতাল মাংসের মতো পড়ে থাকে মাটিতে। অন্য সময় সে চুপচাপ বসে কী যেন ভাবে। আকাশের মেঘপুঞ্জে সে অশনি সংকেত দেখতে পায়। যেন সাংঘাতিক কিছু ঘটে যাবে এই মূহূর্তে। চিত্রার্পিতের মতো বসে থাকেসে । ঘন বিষাদের এই মুহূর্তগুলোতে সব কিছু গুলিয়ে যার তার। নিজেকেও সে ভুলে যায় । প্রথমে গোড়ালিটা শিরশির করে ওঠে…তারপর সেই শিরশিরানি ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে। ভেতরটা জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যায়। একেই কি মরে যাওয়া বলে? রাতের অন্ধকারে এই খাড়াই পাহাড়টা ফুলতে ফুলতে যেমন একটা বিশাল দৈত্যের মতো হয়ে যায় তেমনই তার পেটটাও ফুলতে ফুলতে প্রায় ফেটে পড়ার জোগাড় হয়। সে হাঁসফাঁস করে…নিঃশ্বাস নিতে পারে না। মাথায় ভেতরটা ভোঁ ভোঁ করে ওঠে। কানের পাশে হাজার হাজার ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। চোখের সামনে ভেসে ওঠে শত শত তারা। অদ্ভূত এক নীরবতা নেমে আসে চরাচর জুড়ে…অসীম…অনন্ত এই নীরবতা। ঠিক এমন সময়ই সে ভয়ংকর দৃশ্যটা দেখতে পায় সে। ঘিনঘিনে ঐ কয়লা খাদানের লোকটা তার মাকে জাপটে ধরে আছে। আর সে ঘরের কোণে বসে ঠকঠক করে কাঁপছে। জ্বর আসার আগে এই কাঁপুনি তার খুব চেনা।
বাবা মারা যাওয়ার ঠিক পর পরই এই দৃশ্যটা প্রথম দেখে ফিলিপ। তারপর বার বার ঘুরে ফিরে আসে দৃশ্যটা। কেন যে এমনটা হয় সে নিজেও জানে না…বুঝতে পারে না। দৃশ্যটা কল্পনা করলেই খ্যাপা হাতির মতো ছটফট করে ওঠে সে। মায়ের ওপর তার ভীষণ ঘেন্না। মায়ের দিকে মুখ তুলে কথা বলতে গেই এই প্রচণ্ড ঘেন্নাটা বুকের ভেতর দলা পাকিয়ে আসে। শুধু মায়ের দিকে চাইলেই চোখের সামনে ভেসে আসে দৃশ্যটা। ঐ বীভৎস লোকটার বিরাট কালো হাতটা মাকে পেঁচিয়ে রয়েছে!
মায়ের জন্য আজ তার ছোট্ট বুকে শুধুই ঘেন্না। ছেলেটা কোনও কথা বলে না। নিজের তৈরি একটা খোলসের মধ্যে দিনরাত নিজেকে গুটিয়ে রাকে। সারাদিন কী যে ভাবে! ছেলের মুখ খোলানোর অনেক চেষ্টা করেছে মা। কোনও ফল হয়নি। আসলে মাও তো কোনোদিন ছেলেকে একটু ভালো কথা…একটু মিষ্টি কথা বলেনি। মা শুধু মেরেছে…ধরেছে…গালাগাল দিয়েছে। আর মায়ের মার খেয়ে ছেলের জেদ আরো বেড়ে গেছে। মায়ের প্রতি ঘেন্নায় পাগলের মধ্যে সে আছাড়ি-পিছাড়ি খেয়েছে। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে মূর্ছা গেছে। প্রথম প্রথম মা তাকে খুব মারত…কিল, চড়, লাথি, ঘুসি। কিন্তু তার চোখ দিয়ে এক ফোঁটাও জল বেরোয়নি। তাড়া খাওয়া জন্তুর মতো সে শুধু গর্জন করত আর মাটিতে গড়াগড়ি খেত। তারপর সব তেজ হারিয়ে মড়ার মতো মাটিতে পড়ে থেকেছে…ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এরপর মা অন্য কৌশল নিয়েছে। মার থামিয়ে ছেলের হাতটা পিছমোড়া করে বেঁধে পিন ফুটিয়ে গেছে। নিজের বিষের জ্বালায় নিজেই জ্বলতে জ্বলতে মাটিতে পড়ে গেছে ছেলে। অচৈতন্য ছেলেকে এবার ছেড়ে দিয়ে মা সরে গেছে… ‘হে মা রক্ষে করো’!
মা বাড়িতে থাকে খুব কম। বাইরে লোকের খেতে খেতে ঘুরেই বেশির ভাগ সময় কেটে যায়। খেতে সে কাঠ কুড়োয়, সুযোগ পেলে একটু ভুট্টা চুরি করে পাশের শহরে গিয়ে বেচে আসে। একটু-আধটু যে পয়সা হাতে আসে তা দিয়ে মোটা কাসাভা রুটি…বা কখনও সখনো দু-একটা নোনা মাছ কিনে সে রাতে বাড়ি ফেরে। খাবার দেখলেই হামলে পড়ে ছেলে। তার পেটের খিদের আগুন কখনও নেভে না। মার হাত থেকে খাবার কেড়েকুড়ে গপগপ করে গিলতে থাকে। দিনে…রাতে সে শুধু খাওয়ার কথাই ভাবে…খাওয়ারই স্বপ্ন দেখে।
একদিন ফিলিপের এক বন্ধু এসে জুটল। সেদিন সকাল থেকেই কুকুরটার ঘেউ ঘেউ শুনছিল ফিলিপ। কুকুরটা মনে হয় তার মনিবকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। সারাদিন জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বিকেলের দিকে ফিলিপের কাছে এসে থামে। ফিলিপকে দেখেই কুকুরটা গদগদ হয়ে লেজ নাড়াতে থাকে। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে ফিলিপের পায়ের কাছে শুয়েই পড়ে। রুগ্ন ছেলেটার হতকুচ্ছিত চেহারা দেখেও কুকুরটার একটুও ভয় নেই। ফিলিপও অনেকক্ষণ ধরে জরিপ করে কুকুরটাকে। কুকুরটাকে দেখে সে একটুও অবাক হয়নি ফিলিপ…যেন অনেকদিনের হারানো বন্ধু আবার ফিরে এসেছে। কুকুরটাকে সে একটাও কথা বলে না…একটু পিঠ চাপড়েও দেয় না। এত আদিখ্যেতা দেখানোরই বা কী আছে! কুকুরটা তার কাছে এসেছে…ব্যস মিটে গেছে। এটা হওয়ারই তো কথা ছিল। সেই কুকুরটার মনিব। সারাদিন জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে কুকুরটা তাকেই খুঁজেছে। সে জানে এই কুকুর তাকে কোনোদিনও ছেড়ে যাবে না। কিছুক্ষণ পর তার শান্ত মনে আবার ঝড় ওঠে। আজব সব ভাবনা আসে মনে…যা দেখা যায় না, কাউকে বলা যায় না। মাঝে মাঝে তার মনে হয় একটা অদৃশ্য হাত তার গলা টিপে ধরতে চাইছে। তার মনে হয় কুকুরটা যেন কোনও অজানা দেশ থেকে এসে জুটেছে। সেই দেশ রয়েছে আকাশের অনেক ওপরে যা কেউ দেখতে পায় না। শুধু বিশাল ঐ কাকটা যখন বিকট চিৎকার করে ডানা ঝাপটে আকাশে উড়ে যায় তখন সেই শুধু এই রহস্যে ঘেরা ছায়াময় জগতটা দেখতে পায়। ফিলিপের কেন জানিনা মনে হয় কুকুরটা শুধু শুধু উড়ে এসে জুড়ে এসে জুড়ে বসেনি। কুকুরটা এসে যেন তাকে কোনও বিপদের হাত থেকে উদ্ধার করতে এসেছে।
অনেকক্ষণ পর মুখ খোলে ফিলিপ… ‘সকাল থেকে জঙ্গলে তোর ডাক শুনছি। আমি জানি তুই আমাকেই খুঁজতে এসেছিস’। কুকুরটা আবার গদ গদ হয়ে কুঁই কুঁই করে যায়। হঠাৎ করে এই আদরের ডাক থামিয়ে কুকুরটা তীব্র গর্জন করে ওঠে… সে যেন কোনও বিপদের গন্ধ পেয়েছে। ঐ ঝোপের আড়াল থেকে ফিলিপও কারো একটা পায়ের আওয়াজ শুনেছে। এই আওয়াজ তার চেনা… ‘ওরে থাম থাম…মাম্মা এসেছে’।
বাড়ির সামনে উটকো এই জানোয়ারটাকে দেখে মাথাটা গরম হয়ে যায় প্লাসিদার। কুকুরটাকে সে তাড়ানোর অনেক চেষ্টা করে…কিন্তু সে বান্দা নড়েনা। ফিলিপের পায়ের কাছে শুয়েই থাকে আর চেঁচিয়ে যায়। কুকুরটা কি তাকে ভয় দেখাতে চায়! তাহলে অমন আগুন-চোখ নিয়ে তার দিকে চেয়ে আছে কেন? ভয় পেয়ে যায় প্লাসিদা। তখনকার মতো সে ওখান থেকে সরে যায় ঠিকই কিন্তু মন থেকে তার অস্বস্তিটা যায় না।
ঘরে ঢুকে সন্ধের খাওয়ার আয়োজন করে প্লাসিদা। খাওয়া বলতে আর কি…দু-এক টুকরো মোটা রুটি বইতো নয়। খাবারটা সে ঘরে লুকিয়ে রাখে যাতে ফিলিপ নাগাল না পায়। তারপর এক টুকরো রুটি নিয়ে চলে আসে পাহাড়ের ধারে। এখানেই লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে খেয়ে নিতে হবে। কিন্তু ও ছেলের চোখকে ফাঁকি দেওয়া খুব মুশকিল। সে ঠিক মাকে দেখতে পেয়ে যায়। খাবারটা ছিনিয়ে নিতে তীরের মতো সে মায়ের দিকে ছুটে যায়। এক টুকরো রুটি মাটিতে ছুঁড়ে দিয়ে মা সরে যায়। রুটির টুকরোটা গিয়ে পড়ে ঝোপের ধারে। ফিলিপ রুটিটা কুড়িয়ে নিয়ে বুভুক্ষুর মতো খায়। কুকুরটা লেজ নাড়িয়েই যায়। রুটির এক টুকরো ছুঁড়ে ফিলিপ কুকুরটা দিতে যায়। কিন্তু সে কুকুর মুখ সরিয়ে নেয়। তারপর মাটিতে চিত হয়ে শুয়ে পড়ে। মুখটা তার ঐ মহিলার দিকে।
ওদিকে ছেলের দিক থেকে মুখ সরাতে পারে না প্লাসিদা। ছেলেটা যখন চিবিয়ে চিবিয়ে রুটিটা খাচ্ছিল তখন ওকে যে কী কদাকার লাগছিল! ঘা ঘিনঘিন করছিল প্লাসিদার। ছেলেটা আগে অতটা কুচ্ছিত ছিল না বোধহয়। যত ভাবে প্লাসিদার তত ঘেন্না লাগে ছেলেটাকে। একটা নরকের কীট। মরতে বসেছে…তাও বাঁচার কী চেষ্টা। ছি। ঐ ছেলেটার জন্যই তো তা জীবনে এত যন্ত্রণা। কোথাও সে কাজ পায় না। শহরে বাবুদের বাড়ি কাজ চাইতে গেলে তারা ছেলেটাকে দেখে নাক শিঁটকোয়… ‘না বাপু, তুমি কাজ কর ঠিক আছে…কিন্তু তোমার ঐ ছেলেটাকে এখানে রাখা যাবেনা’। ছেলেটার জন্য ক্রিসান্টোকেও সে কাছে পাচ্ছে না। কয়লা খাদানে কাজ করে ক্রিসান্তো। হাতে টাকাকড়ি আছে। তার সঙ্গে আশনাইটাও বেশ ভালোই জমেছিল…কিন্তু তাদের মাঝখানেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই হতচ্ছাড়া ছেলেটা। সেদিন তো ক্রিসান্তো একেবারে সাফ সাফ জানিয়েই দিল… ‘ছেলেটাই তো তোর যত নষ্টের গোড়া। নাহলে তোর এত কষ্টই হত না। আমার ঘর আছে…ভরপেট খাবার-দাবার আছে। তুই একদম রানি হয়ে থাকতে পারতিস। আর তোকে লোকের খেতে খেতে কাঠ চুরি করতে হত না। কিন্তু তোর ঐ ছেলেটাকে নেবনা…ওকে সোনা দিয়ে মুড়ে দিলেও নয়। ব্যাটার চোখের দিকে চেয়ে দেখেছিস! একেবারে হায়নার চোখ। দেখে তোর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাবে। ওর সারা শরীরে শয়তানির ছাপ। একেবারে পাক্কা শয়তানের বাচ্চা। কে বলবে ও ছেলেমানুষ! চেহারাখানা দেখেছিস! অত শয়তানি বুদ্ধি বাচ্চাদের থাকে না। আমার দিকে এমন করে চায় যেন ছিঁড়ে খুবলে খেয়ে নেবে। ওকে যদি অন্ধকারে পাহাড়ের ধারে পেতাম তাহলে আমি কিন্তু একেবারে…হ্যাঁ একেবারে শেষ…শালা শয়তান! আমি যদি তোর জায়গায় থাকতাম তাহলে…
ক্রিসান্তোর কথা শেষ হওয়ার আগেই ঝোপের ধার থেকে কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে ডেকে ওঠে। চমকে ওঠে প্লাসিদা। এই কুকুরটাই তো তাদের ঘরে ঘাঁটি গেড়েছে। চব্বিশ ঘণ্টা ফিলিপের পায়ের কাছে পড়ে রয়েছে! কুকুরটা যেন তার মনিবকে খুঁজে চলেছে। প্লাসিদার পায়ের কাছে এসে কিছু একটা শুঁকে আবার গর্জন ওঠে।
প্লাসিদা ঠিক তখনই ক্রিসান্তোকে বলছিল… ‘কিন্তু ধরা পড়ে যাই’।
‘ না না কেউ ধরতে পারবে না। যে ছেলে দু-পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারে না সে যদি পাহাড় থেকে পড়ে যায়…
এখন ছেলের ঐ বিচ্ছিরি…পোকায় খাওয়া চেহারাটা দেখে ক্রিস্তানোর ইঙ্গিতটা মনে পড়ে তার প্লাসিদার… ‘নাহ্, কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারবে না’।
চারপাশটা ভালো করে দেখে নেয় প্লাসিদা। চারিদিকে ভূতুড়ে নৈঃশব্দ। জনমনিষ্যি নেই। চারদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। ঐ অনেক নীচে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দু-চারটে বাড়ি আছে অবশ্য…চাষাভূসোদের বাড়ি। অত দূর থেকে কেউ কিচ্ছু টের পাবে না। বাড়িগুলোর চিমনি থেকে হালকা নীল ধোঁয়া মাঝে মাঝে চোখে পড়ে।
চারদিকটা ভালো করে জরিপ করার পর প্লাসিদার কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগে। গলার কাছে একটা দলা আটকে রয়েছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আকাশে কালো মেঘে ছেয়ে গেছে…মেঘের নীল ছায়া পড়েছে নীচের উপত্যকায়। দূরে ঐ দিগন্ত রেখার কাছে শেষ পাহাড়টার ওপর থেকে বৃষ্টি ধেয়ে আসছে। একের পর এক বাজের শব্দে রাত্রির নৈঃশব্দ ভেঙে খান খান। মেঘের গুরু গুরু ডাকে কি অশুভ সংকেত লুকিয়ে রয়েছে? স্বয়ং শয়তান এখন ভর করেছে প্লাসিদার মনে…কোনও অন্ধকার সুড়ঙ্গে সে তলিয়েই যাচ্ছে।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তোর ঐ ছেলেটা মানুষ নয়। একটা দৈত্য। দেখ দেখ শয়তানটা কীভাবে তাকিয়ে আছে দেখ! যেন এক্ষুনি গিলে খেয়ে নেবে! হে মা রক্ষে করো! চোখদুটো ভাটার মতো জ্বলছে…দাঁতগুলো কিড় মিড় করছে! হা ভগবান! একটা জড় পদার্থের মতো বেঁচে ও পাবেটা কী! পেটে গিজগিজে পোকাগুলো তো আস্তে আস্তে ওর জীবনীশক্তি শুষেই নিচ্ছে! জ্বর আসার আগে কেমন পাগলের মতো কাঁপে দেখিস না…মনে হয় যেন জিনে পেয়েছে। হা ভগবান… এভাবে আমি কিছুতেই বাঁচতাম না…তার চেয়ে মরণ ভালো’।
কুকুরটা আবার চেঁচিয়ে ওঠে। ক্রিসান্তো চমকে ওঠে… ‘দেখ, কোত্থেকে আবার একটা কুকুর জুটিয়েছে! জীবনে কত কী যে ঘটে সব কি আর বোঝা যায়?’
গ্রোগ্রাসে রুটিটা গিলে আবার মায়ের দিকে হাত বাড়ায় ফিলিপ… ‘দে আরো দে…আমার খিদে পেয়েছে’।
ছেলেকে দেখে বুকটা কেঁপে ওঠে প্লাসিদার। ছেলেটাকে এত অচেনা মনে হচ্ছে কেন? ও কি মানুষ নাকি প্রেতাত্মা! ছেলেটাকে বড় রহস্যময় মনে হচ্ছে। ঐ চোখের মধ্যে যেন কোনও অশুভ ইঙ্গিত। ছেলেটার বড্ড জেদ। দিন আনি দিন খাই সংসারে এত খাবার সে কোত্থেকে জোটাবে? মনের মধ্যে আবার সেই ভাবনাটা খেলে যায় প্লাসিদার। সে একটা রুটির একটা টুকরো ছিঁড়ে ঝোপের দিকে ছুঁড়ে দেয়। সেটা গিয়ে আটকে যায় ঝোপের একটা ডালে। নীচে অতলান্ত খাদ।
ফিলিপ উঠে দাঁডায়। চোখের কোণে বিদ্যুৎ খেলে যায়। জ্বলন্ত চোখে সে মায়ের দিকে চায়। সে সব বুঝে গেছে। মা কি চায় সে বুঝে গেছে। তার জন্য মরণফাঁদ বিছিয়ে রেখেছে মা। সে যদি রুটিটা আনতে যায় তাহলে নিশ্চিত মৃত্যু। কাঁটা গাছের ডালটা তার ভার নিতে পারবে না। কিন্তু মা যখন চাইছে তখন তাই হোক। অনেক কষ্টে মনকে বুঝিয়ে সে ঝোপের দিকে এগোয়।
কিন্তু এই সময়ই বিদ্যুৎ বেগে ছুটে আসে কুকুরটা। এক লাফে সে ঝোপের ওপর গিয়ে লাফায়। কিন্তু তার ভারে ছোট গাছটার ডাল নুয়ে পড়ে। কুকুরটা সোজা গভীর খাদে। আর কোনও চিহ্ন দেখা যায় না তার।
সে এক ভয়াবহ রাত। মুষলধারে বৃষ্টি। কালো আকাশের বুক চিরে ঝলছে উঠছে আলো। বাজের শব্দে বুক কেঁপে ওঠে। এ কোন প্রলয় আসতে চলেছে আজ! খড়ের চালের ফুটো দিয়ে জলে ভেসে যাচ্ছে ঘর। পথে ঘাটে যেন সহস্র নদী সাপের মতো ফুঁসছে। অনেকক্ষণ ধরে খাদের নীচ থেকে কুকুরটার কাতর ডাক শোনা গেছে। কিন্তু এখন সব চুপ।
মা-ছেলে শুয়ে আছে ঘরে। কারো মুখে কোনও কথা নেই। বিদ্যুৎ ঝলসে উঠছে। সেই আলোয় ছেলের চোখটা দেখে পায়ের তলার মাটি সরে যায় প্লাসিদার। ও যে পাক্কা শয়তানের চোখ…ধূর্ত, নিষ্ঠুর। প্লাসিদার ঘুম আসে না। ছেলেকে তার ভয় হচ্ছে। ছেলের ভেতরের শয়তান জেগে উঠে তার গলাটা টিপে দেবে না তো?
ওদিকে ছেলে মাঝে মাঝেই বিড় বিড় করে কী যেন বলছে। ভালো করে শুনে মাথাটা ঘুরে যায় প্লাসিদার।
‘মাম্মা, মাম্মা তুমি কেন আমাকে মারতে চাও’?